বিজ্ঞাপন দিন

জলঢাকায় অনাথ আশ্রম "চাঁদমনি"র ৭দিনব্যাপী হস্তশিল্প ও প্রদর্শনী মালার উদ্বোধন

আবেদ আলী স্টাফ রিপোর্টারঃ আয়রে আয় চাদঁ মামা টিপ দিয়ে যা, চাদেঁর কপালে চাদঁ টিপ দিয়ে যা। নিষ্পাপ কোমলমতি শিশুদের বাংলার মা জোনাকী সন্ধ্যায় তার ফুটফুটে সন্তানকে কোলে নিয়ে আকাশের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বলে সোনামণি ঐ দেখো চাদঁ মামা। তখন ফোকলা দাঁতে হেসে শিশু চাঁদের দিকে চেয়ে। এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চাওড়াডাঙ্গী গ্রামের দুস্থ নারী কল্যাণ সংস্থা চাঁদমনি আশ্রমে। কথায় আছে যাদের কেউ নেই, তার সহায়তা করেন সৃষ্টিকর্তা। আর সেও কিন্তু হয় কেউ না কারও মাধ্যমে। ঠিক এরকমেই এক সাদা মনের মানুষ চাঁদ মামা আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলাল। তার ব্যক্তি উদ্যোগে গড়েতোলা চাঁদমনি নামক আশ্রমে আশ্রিত এ অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের পিতৃমাতৃহীণ অনাথ কন্যাদের কাছে তিনি মামা নামে পরিচিত। যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এতিম শিশু কন্যাদের খুজেঁ খুজেঁ নিয়ে এসে ঠাই দেন তার আশ্রমে। সেখান থেকে বাদ পড়েনি হরিজন পল্লীর মেয়েরাও। তার কাছে যেন নেই কোনও জাতির ভেদাভেদ। আবাসিক এবং অনাবাসিক সবমিলে ওই আশ্রমে এখন পর্যন্ত ঠাই হয়েছে প্রায় ৬ শত জন শিশু নারীর। তার মধ্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে কেউ বিয়ের পিঁড়িতে আর অনেকেই নিজ বাড়িতে চলে যায়। বর্তমানে ওই আশ্রমের ৭০ জন অনাথ কন্যা বিভিন্ন শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার চাওড়াডাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই চাঁদমনির আয়োজনে ৭ম বারের মতো উদ্বোধন করা হয় দ্বিবার্ষিক হস্তশিল্প ও প্রদর্শনী মেলা। মেলার ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহেদ বাহাদুর। এ উপলক্ষে চাঁদমণি আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলালের সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজাউদ্দৌলা, সহকারী কমিশনার (ভুমি) গোলাম ফেরদৌস, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম পাশা এলিচ, জেলা জাসদ সভাপতি অধ্যাপক আজিজুল ইসলাম, উপজেলা সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম মিতু ও স্কাউট সাধারণ সম্পাদক মর্তুজা ইসলাম প্রমুখ। মেলায় কথা হয় ওই আশ্রমের ২য় শ্রেণীর সুমনা আক্তারের সাথে। তার বাড়ী ডিমলা উপজেলার চাপানী চৌধুরী পাড়া গ্রামে। বাবা নেই, অভাবের সংসার। তাই ৭ মাস আগে তার মা মঞ্জুয়ারা বেগম সুমনাকে আশ্রমে রেখে ১০ বছেরর ছেলে মঞ্জুরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে কাজের সন্ধানে চলে যায় ঢাকায়। সুমনার কাছে ভালমন্দ বিষয় জানতে চাইলে কষ্টের ঘরে জন্ম হলেও হাসিখুশী মুখের মধ্যে দুঃখের কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি। তার একটাই লক্ষ পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়া। শুধু তাই নয়, ৩য় শ্রেণীর মিতু ও তার বড় বোন মীম ৫ম শ্রেণীতে পড়ে, বাড়ি কিশোরগঞ্জ উপজেলার ভেরভেরী গ্রামে। তাদেরও জায়গা হয়েছে ওই আশ্রমে। কারণ কর্মস্থল ঢাকা থেকে নিজ বাড়ি ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যায় তাদের বাবা। দরিদ্র ওই পরিবারেটিতে আয় রোজগারের ছিলনা কোন পথ। এসব জানার পর চুপ থাকেনি হাজ্বী দুলাল। ওদের দু'বোনকে পিতার স্নেহে আপন করে নিয়ে জায়গা দেন তার আশ্রমে। সুমনা, মিতু আর মীমেই নয়। ২০১৪ সালে আকলিমা আক্তার বর্তমানে ১০ম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত ও তার ছোট বোন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর জান্নাতুল ফেরদৌসী জানায়, আমরা দুই বোন, বাড়ি জলঢাকার বালাগ্রাম ইউনিয়েনের কাশিনাথ পুরে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আমাদেরকে এই চাঁদমণি আশ্রমে রেখে চলে যায়। পরে শুনেছি মা আবার বিয়ে করেছে। মামা আমাদের বাবা মায়ের চেয়েও বেশি স্নেহ করেন। আশ্রমটির কোমলমতি ওই শিশুরা মামার আদরে ভাবতে ভূলে গেছে যে, তারা কোথায় থেকে এসেছে। তবে তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে নিজেকেও উৎফুল্ল মনে হয়েছিল। কারণ তাদের মুখে প্রতি মুহুর্তে ছিল হাসির ঝিলিক। পিতা মাতার আদর স্নেহ ভালবাসা কোনও টারে কমতি পায়নি তারা আশ্রয় দাতা হাজ্বী পিজিরুল আলম দুলালের কাছে। নীলফামারী জেলার জলঢাকা পৌর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে এক অজোপাড়া গাঁ চাওড়াডাঙ্গী গ্রাম। সেখানে অবস্থিত চাঁদমনি আশ্রম। যাদের বা কিংবা মা নেই, তাদেরই ঠাঁই এখানে। অবহেলিত এ অঞ্চলের কর্মহীন মানুষরা তাদের সন্তানদের স্কুলের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে না পারলেও হাজ্বী দুলাল এসব ঝড়ে পড়া কন্যা শিশুদের আপন করে নিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শিখান কম্পিউটার, সেলাই ও কুটির শিল্পের কাজ। বৈবাহিক জীবনে চাঁদমনি প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলাল (৮৭) নিঃসন্তান, কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। তাই এখন জীবনের সমস্ত জমানো সঞ্চয় নিজের কাজে ব্যয় না করে, করছেন এতিম মেয়েদের পিছনে খরচ। যেন তারাও উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সমাজে মাথা উচু করে দাড়াতে পারে। ১৯৯৯ সালে মাত্র ৫ জন এতিম কন্যাকে নিয়ে শুরু হওয়া চাঁদমনি আশ্রমেটিতে এখন পর্যন্ত ঠাই হয়েছে প্রায় ৫শত জনের। বর্তমানে সেখানে ৭০ জন অনাথ রয়েছে। জীবন সংসারে সমস্ত চিন্তা চেতনা ধ্যান ধারণা তার আশ্রমের এতিম মেয়েরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে আর প্রমাণ করে দিবে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। পিজিরুল আলম দুলাল চাঁদমনি আশ্রমের পাশাপাশি রিক্সা/ভ্যানে খবরের কাগজ ও বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হিসাবে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোতে মানুষকে পড়তে উৎসাহিত করেন। সেই সাথে এই সাদা মনের মানুষটি প্রতিদিন খোঁজখবর নেন, কার বাড়ীতে খাবার নেই, কোথায় বাল্যবিয়ে হচ্ছে তা রোধে ওই বাড়িতে গিয়ে বোঝানোই যেন তার দায়িত্ব। দুলাল হাজ্বী, বয়সের ভারে বতর্মানে নুজ্য। গোটা উত্তরাঞ্চলে এরকম একটি নারী আশ্রম নেই। মানবতার সেবায় মানুষ মানুষেষ জন্য এ প্রবাদটি বাস্তবে তিনি রুপায়ীত করছেন। শুধু এতেই শেষ নয় ! বয়স্ক শিক্ষা, ফ্রি সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র, মক্তব ও শরীরচর্চা সহ নানান উদ্যোগ তার। পিজিরুল আলম দুলাল জানান, মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করে অসহায়দের পাশে থেকে সচেতনতামুলক কাজের মাধ্যমে দেশে পরিবর্তন আনতে হবে এটাই মুল লক্ষ।