বিজ্ঞাপন দিন

‘মুহাম্মদ (সা.)’ চলচ্চিত্র নিয়ে মাজিদ মাজিদির সাক্ষাৎকার

জল ডেস্ক:ইসলাম এবং মহানবী (সা.)-এর চরিত্রের দয়া বা করুণার রূপটি তুলে ধরেছি : মাজিদ মাজিদি

প্রশ্ন: মুহাম্মদ (সা.) জীবন আলেখ্য কেন আপনার ছায়াছবির উপজীব্য করলেন?

মাজিদ মাজিদি: সত্যিই এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে গত এক দশক ধরে মহানবী (সা.) এবং ইসলামের অবমাননাকর নানা তৎপরতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। পশ্চিমা দেশসহ অন্য কিছু দেশও এ জাতীয় তৎপরতায় লিপ্ত। মহানবীকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন বা ছবি আঁকা হয়েছে এবং সহিংসতার সঙ্গে মহানবীকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও এসবের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র অবস্থানের কোনো সম্পর্কই নেই। বরং পশ্চিমারাই মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালাচ্ছে।
মুসলিম দেশগুলোতেও একই ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। এ সব দেশে ইসলাম একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে এবং বাস্তবে পণবন্দি হয়ে পড়েছে। এমন সব ঘটনা প্রবাহের মুখে একজন চিত্রনির্মাতা এবং শিল্পী হিসেবে আমরা নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কখনো কখনো পশ্চিমা দর্শকদের প্রতি খুবই বিতর্কিত এবং হামবড়া মনোভাব দেখানো হয়েছে। আমি ভাবলাম, ইসলাম এবং মহানবী (সা.)-এর চরিত্রের দয়া বা করুণার রূপটি তুলে ধরা উচিত। দয়ার সেই মহাসাগরের একটি মাত্র বিন্দু- এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন: মহানবী (সা.) জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট অংশের প্রতি আপনি দৃষ্টি দিয়েছেন। সেখানে মহানবীর শৈশব এসেছে। কেন আপনি শুধু শৈশবকেই বেছে নিয়েছেন?

মাজিদি: চলচ্চিত্রটিতে মুসলিম বিশ্বে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই আমরা নবী জীবনের এমন একটি অংশ বেছে নিয়েছি যা নিয়ে সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে সামান্যই মতপার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া এ অংশ বেছে নেয়ার আরেকটি কারণ হলো, নবী জীবনের এ অংশে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কিছু দিকনির্দেশনাও রয়েছে যা আমাদের তরুণদের উপকারে আসবে। বর্তমান সময়ে তরুণদের জীবনে আধ্যাত্মবোধের অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে উঠেছে। শিয়া-সুন্নির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির নানা অপচেষ্টা চলেছে। কিন্তু এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি যে, আমরা সবাই একই পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ আছি। ইসলামের সঠিক প্রচার করে এ পতাকার যথার্থ বাহক হয়েছেন মহানবী (সা.)।

প্রশ্ন: নবী জীবনের সুনির্দিষ্ট এ অংশ বেছে নেয়ার জন্য আপনি অনেক গবেষণা করেছেন। চলচ্চিত্র তৈরির আগে যেসব গবেষণা করেছেন সে বিষয়ে কি আমাদের আরো কিছু আপনি বলতে পারেন?

মাজিদি: গবেষণার বিষয় তুলে ধরতে গেলে বলতে হবে, শিয়া ও সুন্নি উভয় আলেমদের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ আমরা করেছি। এ দুই সম্প্রদায়ের মুসলমানের ইসলামি ইতিহাসের ক্ষেত্রে গবেষণা চালানো হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মহানবী (সা.) শৈশব থেকে নব্যুয়ত লাভ পর্যন্ত ইসলামি ইতিহাসে জানার সূত্র খুবই সীমিত। এ ছায়াছবি নির্মাণের কল্যাণে ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিদ্যা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সূত্রের নানা উৎসের খোঁজ পেয়েছি। ভালো উৎস খুঁজে বের করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু কেবলমাত্র শাব্দিকভাবে ইতিহাস জানার কথা আমাদের ছিল না। সেকালের মানবিক পরিস্থিতিতে মহানবীর প্রতিক্রিয়া কী হয়েছে সার্বিকভাবে তাই ছায়াছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মেয়েদের জ্যান্ত কবর দেয়ার বিষয়টি উদাহরণ হিসেব তুলে ধরা যায়। ছায়াছবিতে এ বিষয়টি চিত্রায়ণ করা হয়েছে। ঘটনাটি হয়ত ঠিক এ ভাবে ঘটেনি কিন্তু নবী (সা.) কীভাবে এ জাতীয় ঘটনার মোকাবেলা করেছেন এবং এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে ও তার প্রতিক্রিয়া নাটকীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রশ্ন: এ চলচ্চিত্রে যুক্তদের ক্ষেত্রে বা নির্মাণ দলটির ক্ষেত্রে আপনি খুবই বাছ-বিচার করেছেন। এখন আপনার নির্মাণ দলের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী কী উপাদানের কথা বিবেচনা করেছেন?

মাজিদি: ইরানি বা বিদেশি যাদেরকেই এ ছবিতে কাজ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে তাদের অনেক বাছ-বিচারের ভিত্তিতে পছন্দ করা হয়েছে। ইতালির সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারোর কথাই ধরুন। আমি তার অনেক কাজ দেখেছি। কোপোলা, বেরনারদো বেরতোচি, কালোর্স আরা, ওয়ারেন বেটিসহ অন্যান্য খ্যাতনামা চিত্রনির্মাণের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এ সব চিত্রনির্মাতাদের অনেকের প্রতিই আমাদের নজর ছিল। যখনই স্তোরারো’র জাদুকরি কাজ দেখি তখনই তাকে প্রশংসনীয় মনে হয়। আলো এবং ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্যের যে চমৎকার নকশা ফুটিয়ে তোলেন তিনি, তা বরাবরই ঈর্ষনীয় মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে- এমন দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে পারেন এমন একজনকে আমি নিশ্চিতভাবেই চাচ্ছিলাম। স্তোরারো একটি বই লিখেছেন। তার নাম ‘আলোর মাধ্যমে চিত্রকর্ম’। তার এ বইটা দেখেই আমার মনে হলো যার খোঁজ আমি করছি সে ব্যক্তি তিনিই।
ভেনিস নগরী নিয়ে চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে মি. কেরেকার। তাকেও আমাদের দলে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি যদি ‘না’ বলতেন তবে ভেনিসকে কেন্দ্র করে নির্মিত ছবিটি যে সেট বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে তা বুঝতে পারতাম না; হয়ত ধরেই নিতাম এটি সত্যিকার ভেনিস নগরীতে তৈরি করা হয়েছে। ভেনিস নিয়ে তার ছবিটি সত্যিই চমৎকার এবং মহৎ। অন্যদিকে স্পেশাল এফেক্টের জন্য আমি স্কট ই অ্যান্ডারসনের কথা ভেবেছি। অস্কার বিজয়ী টারমিনেটর ছবিতে তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সংগীতের জন্য এ আর রহমানের কথা আমরা ভেবেছি। তিনি আকর্ষণীয় অনেক কাজ করেছেন এবং নিজে মুসলমান। কাজেই তিনি ইসলামের নির্যাস তুলে ধরতে পারবেন।
এ চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ইরানিদের নিয়োগের বিষয়ে গভীর সমীক্ষা চালিয়েছি। সম্ভবানাময় ইরানি অভিনেতাদের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করেছি। সমগ্র ইরান জুড়ে খোঁজ করে চলচ্চিত্র এবং নাটকের ক্ষেত্রে সেরা প্রতিভাদের এ ছায়াছবিতে ব্যবহার করেছি। মুহাম্মদ আগারির কথাই ধরুন, তিনি আবু লাহাবের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বয়সে তরুণ এ অভিনেতার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। এ ছাড়া, অন্য সব অভিনেতা হলেন ভবিষ্যতের প্রতিভাধর শিল্পী।
প্রশ্ন: আপনার এ ছবিতে আন্তর্জাতিক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কেন বেছে নেন নি?

মাজিদি: একটি ছায়াছবির পরিচয় তুলে ধরেন তার অভিনেতা। দর্শক প্রথমেই অভিনেতাদের মাধ্যমে কোনো চলচ্চিত্রকে চেনেন, পরে অন্যান্য বিষয়ে নজর দেন। ক্যামেরাম্যান কে এটা জানা দর্শকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু নয়। বরং ছায়াছবিতে আকর্ষণীয় কী আছে তাই তারা দেখেন। পেশাদাররা ক্যামেরা, সেট ফেলা এবং অন্যান্য জিনিসের ওপর নজর দেন। অনেক সময়ই সাধারণ মানুষ কোনো ছায়াছবির নাম পর্যন্ত ভুলে যান কিন্তু অভিনেতার বরাত দিযে ওই ছায়াছবির প্রসঙ্গে কথা বলেন। কাজেই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ছায়াছবিটি ইরানিদের তৈরি তা দেখাতে হবে। এ ছাড়া, ইরান এ ছবিটি তৈরি করেছে তাও তুলে ধরতে হবে। এ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো অভিনেতারা এবং তারা ইরানি। ইরানের শিল্পীদের অভিনয় সক্ষমতা যে ব্যাপক সে কথা আগেই বলেছি এবং আমি জানি, এ সক্ষমতা এখনো ভালো করে আবিষ্কৃত হয় নি। আমার তৈরি সিনেমা ‘সং অব দ্য স্প্যারোর’ কথাই ধরুন, সেখানে অভিনয় করেছেন নাজি। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পাওয়া আগে তিনি অজ্ঞাত পরিচয় অভিনেতা ছিলেন। এটি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, অভিনয়ে ইরানের বিশাল সক্ষমতা রয়েছে। এ ছাড়া, চলচ্চিত্রের পরিচিতিটিও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: সামগ্রিকভাবে এটি ইরানি সিনেমা নাকি শুধু একটি সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত হবে?

মাজিদি: সিনেমাটি দেখতে দিন, কারণ এখন যাই বলব তা আত্মপ্রশংসামূলক হবে। এ সিনেমার কারিগরি দিকটি দেখতে এবং মূল্যায়ন করতে হবে। তবে সিনেমার বিষয়বস্ত সম্পর্কে বলতে চাই, চেতনার দিক থেকে এটি ইসলামের যথার্থ রূপের কাছাকাছি রয়েছে। ইসলামকে যদি এক কথায় তুলে ধরা হয় তবে আমরা বলব এটি করুণার ধর্ম। অবশ্য ইসলামের কঠোর অনুশাসনমালা রয়েছে এবং আল্লাহর ধর্ম হিসেবে এ সবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নাস্তিক্যের মোকাবেলায় এর সহায়তা নেয়া হয়। কিন্তু ইসলাম কখনোই হামলাকারী নয় বরং মহৎ গুণাবলীকে রক্ষা করে।
প্রশ্ন: এ ছবি নির্মাণে ব্যাপক পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ছায়াছবিটির জন্য পূর্ণ নগরী নির্মাণ করতে
হয়েছে। কারিগরি দিক সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলবেন কি? এ ছবি কীভাবে ইরানের সিনেমা শিল্পকে সহায়তা করেছে?

মাজিদি: আসলে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি খতিয়ে দেখা হয়েছে বিষয়গুলো। সিনেমাটির প্রয়োজনে যে নগরী নির্মাণ করা হয়েছে তা মুসলিম বিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। কেবল ইরান নয় বরং মুসলমান বিশ্বের চিত্র নির্মাতারা এখানে আসতে পারবেন। অবশ্য এটি নিশ্চিত ভাবেই ইরানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াবে। অনেক দেশই এটি ব্যবহার করতে পারবে। এ নিয়ে কোনো প্রচার চালানো হয় নি কিন্তু এরপরও অনেক দেশেই এখানে এসে এটি ব্যবহার করতে চাইছে। সিনেমাটি দেখানো হলে আমি এখানে এসে এটি ব্যবহারের জন্য সবার প্রতি আমন্ত্রণ জানাব। এটি ব্যাপকভাবে ইরানের সিনেমা নির্মাণের সক্ষমতা বাড়াবে। অন্যান্য দেশ যখন এখানে আসবে তারা ক্যামেরাম্যান, শব্দশিল্পী, অভিনেতা, সেট নির্মাতা, পোশাক নির্মাতাসহ ইরানের অন্যান্য সক্ষমতা ব্যবহার করবে। আর এতে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই ইরানের চলচ্চিত্রের সহায়তা হবে। এটি নিছক সিনেমা নয় বরং একটি সংস্কৃতি প্রবাহ যা ইসলামি বিশ্বের সিনেমায় প্রবাহিত হবে।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্নটি হলো, মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবে কীভাবে গেল ছায়াছবিটি এবং কেনই বা এই চলচ্চিত্র দিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করলেন?

মাজিদি: অনেক চলচ্চিত্র উৎসবই ছায়াছবিটি দেখানোর সুযোগ পেতে চাইছিল। ধরুন, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব এটি প্রথমে দেখানোর বিষয়ে আগ্রহী ছিল। কিন্তু কোনো কোনো আরব দেশের অর্থে তৈরি লবির চাপে শেষ পর্যন্ত এ থেকে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব বিরত থাকে। এ সব লবির কারণে অনেক চলচ্চিত্র উৎসবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এ ছবিটি অনেকেই দেখাতে চেয়েছিল তা বেশ নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।     বেশ নি