বিজ্ঞাপন দিন

দার্জিলিং ভ্রমণ বজলুর রশীদ

বজলুর রশীদ : ঘুরে এলাম সেই শহরে ঘুরে এলাম - যেখানে বৃষ্টি ও মেয়েদের কোন ভরসা নেই। সেই শহর পাহাড়ি চুড়ায় ৬৯৮০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত - হিমালয়ের পাদদেশে মেঘের চাদরে আবৃত এক স্বপ্নময় এক শহর। প্রতিবেশী হলো নেপাল, সিকিম ও ভুটান। তাই সংমিশ্রণ বেশ প্রবল। আমি একটু ভ্রমণ পিয়াসু ঘুরতে ভাল লাগে। এবারে আমার গন্তব্য ভারতের দার্জিলিং। ভিসা নেয়াই ছিলো। গত মার্চে যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারিনি। কয়েকদিন থেকেই বেশ ঘাটাঘাটি করছিলাম। ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী যখন কলকাতায়, তখনকার ব্রিটিশগুলা গরমকালটা কাটিয়ে দিতে খুঁজে বের করেছিলো হিমালয়ের কোলে পাহাড়কন্যা দার্জিলিং। অসাধারণ সৌন্দর্যের মেঘের দেশ । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, প্রাচুর্যেভরা আর পশুপাখি, অপরূপ পাহাড়ি অঞ্চল চা বাগান, পুঞ্জীভূত মেঘের কণা ভেদ করে অাঁকাবাঁকা পথের ধারে পুরো দার্জিলিং, অপরূপ সৌন্দর্যের একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক লীলাভূমি- সব কিছুতেই মুগ্ধতা, এ যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ। সকাল ৮ টা ২৪ মে, ২০১৬ - আমি আর বন্ধু রবিন বাস এ পৌঁছে যাই বুড়িমারি বর্ডারএ।   সপ্নের দার্জিলিং! আর আমার আছে চায়ের নেশা। তো অবশেষে প্রায় ইন্ডিয়া ঢোকার পথে। বাংলাদেশ বর্ডার এ কার্জক্রম সারতে ১ ঘন্টা লাগলো। দালাল আছে। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। তেমন ঝামেলার কিছুই নেই। বুড়িমারি ইমিগ্রাশন অফিসে একটা নির্দিস্ট রুম এ গেলাম। ২/৩ জনের লাইন। এটা তো অফ সিজন - তাই অত মানুষ ছিলো না। সিজনের সময় (মার্চ - এপ্ল্রিল বা অক্টবর - ডিসেম্বর) এ অনেক মানুষ হয়। যাই হোক আমার পাসপোর্ট নিয়ে জিজ্ঞসা করলো কি করি, কেনো যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি ইত্যাদি।
এখানে একটা বহির্গমন কার্ড দিলো ফিলাপ করার জন্য। করলাম। এরপর আরেক রুম এ গেলাম। ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়াই ছিলো। এখানে দিলাম বন্দর ট্যাক্স + ১০০ টাকা। (১০০ টাকা এই সাইডে, ইন্ডিয়ার সাইডেও আরো ১০০ দিতে হবে) এরপর আবার প্রথম রুম এ। এখান থেকে বের হয়ে সাইন নেয়ার জন্য গেলাম বর্ডারে একটা ছাউনি তে। নিয়ে ফিরলাম। আবার সেই প্রথম রুম। সিল ছাপ্পর মেরে ব্যাস এদিকের কাজ শেষ। নাস্তা করে নিলাম। এবার ১৫০ ফুট দুরেই ইন্ডিয়ার কাস্টমস এ গেলাম। এখানেই পাস পোর্ট জমা নিয়ে জিজ্ঞাসা বাদ করলো। ফি নিলো ১০০ টাকা। এরপর এক টা রুমে ছবি তুলল। ব্যাগ চেকিং করলো। অবশেষে সব সারতে আরো এক ঘন্টা। এখান থেকে বাংলা টাকা ১০০০ টাকার কম রেখে (১০০০ টাকা লিমিট) বাকি টাকাগুলো  ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। ৮৩ রপি করে পেলাম প্রতি ১০০ টাকায়। তার পর চেংড়াবন্ধায় বাস একটু পরেই ছেড়ে দিলো। আহ। অবশেষে ইন্ডিয়া। প্রায় দের ঘন্টা পর বাস পৌঁছে গেলো শিলিগুড়ি। ওখানে নেমে এদিক সেদিকে হাটছিলাম। হালকা নাস্তা করলাম। চা খেলাম। পরে ১ টা ছেলের পরামর্শ মত শিলিগুড়ি জংশন চলে আসলাম। কাছেই। ২০ টাকা রিকশা ভাড়া। এসে টিকেট কাটলাম শেয়ার জিপ এর - এটা নিয়ে যাবে আমাদের দার্জিলিং। ১০ জন হয়ে গেলেই ছেড়ে দিলো। ভাড়া নিলো ২০০ রুপি, আর তারপর তো রুপকথার মত গল্প। এত সুন্দর রাস্তা গুলো। কি পরিষ্কার আর ২ পাশ জুড়ে গাছ পালা। বুঝিনি আরো দারুন চমক অপেক্ষা করছিলো। শিলিগুড়ি থেকে আধা ঘন্টা পরেই আমরা দার্জিলিং এর পাহাড়ি পথে প্রবেশ করি - আর একটু পরেই আমাদের মাথা নষ্ট হতে থাকে ভীষণ মস্রিন রাস্তা, রাস্তার পাশে ঝ্রনা আর দুরের দ্রিশ্যাবলি দেখে। ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এত সুন্দর।
মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝর্না চোখে পড়ছিল। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনা গুলো ফুলে ভরা। এরা এত ফুল প্রেমী। দার্জিলিং বাসিরা আসলে গোর্খা জাতি। স্কুলের বাচ্চাদের দেখতে পেলাম। এখানে অনেক স্কলে বাংলাদেশ থেকেও পড়তে আসে। একটা জায়গায় ১০ মিনিট বিরতি দিলো। আমরা খেলাম ভেজ পুরি?, মম, ভাত ইত্যাদি। আবার সপ্নের মত পথ ধরে যাত্রা শুরু। প্রায় ঘন্টা ২ পরে আমরা পৌঁছে গেলাম। হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জিপ ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেলো একটা হোটেলে। পছন্দ হলে নেবো। দেখে পরে আরো ২ টা হোটেল দেখে উঠে পড়লাম একটাতে। দার্জিলিং এর একদম মাঝখানে একটা উদ্যান বলা চলে। একপাশে কিছু দোকান। দুরে সারি সারি পাহাড় - এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্ছন জঙ্ঘা নাকি দেখা যায়। ঘন মেঘের ভেলা ঠিক আমাদের পাশে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো। ২ পাশে বেঞ্চ আছে। প্রচুর মানুষ বসে আসে। এখানে বসলাম কিছুক্ষণ। উপভোগ করলাম এখানের পরিবেশ। সিড়ির ধাপ অনেক গুলো পরে সামনে মঞ্চ মত। ওখানে বড় পর্দায় গান ছাড়া হচ্ছিলো। সব মিলিয়ে দারুন জায়গাটা। কিছু দোকান ঘুরলাম এখান থেকে। হালকা কেনাকাটা। পরে ফিরে এলাম। ক্লান্ত থাকার কারনে রাত বেশি না জেগে দিলাম ঘুম।
দার্জিলিং শহরে মোটামুটি ১৭ টি দর্শণীয় স্থান আছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ক) থ্রি পয়েন্টস ৭৮০০ ফুট উঁচুতে টাইগার হিল। খুব ভোরে এখানে পর্যটকদের ভীড় লেগে যায়। আকাশ সারাক্ষণ মেঘলা থাকার কারণে সূর্যোদয় দেখতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। টাইগারহিল থেকে ফেরার পথে পড়বে পৃথিবীর অন্যতম উঁচু রেল স্টেশন ঘুম। এর উচ্চতা ৬৯০০ ফুট। তারপর বাতাসিয়া লুপ। ছোট্ট পার্ক থেকে দেখা যাবে পুরো দার্জিলিং শহর। এই ৩ পয়েন্ট দেখার পর রাস্তার পাশের দোকান থেকে পুরি আর সবজী দিয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে নিন। খ) সেভেন পয়েন্টস চিড়িয়াখানা ও হিমালয়ান মাউন্টেইনেরিং ইনিস্টিটিউট এক সাথে দেখা যাবে। পরবর্তী গন্তব্য চা বাগান। ছবি তোলার জন্য দারুণ জায়গা ! এর একটু উপরেই পাহাড়ের গায়ে তিব্বতি এতিমদের আশ্রম। পাশেই তেনজিং রক। দড়ি বেয়ে ১১০ ফুট পাহাড়ে উঠতে হলে ১৫ টাকার টিকিট করতে হবে। এই সব দেখতে দেখতেই দুপুর। গ) ফাইভ পয়েন্টস প্রথমে যাদুঘর দেখা। তারপর জাপানি মন্দির। লাল কুঠি বা কাউন্সিল হাউজ দেখার পর এভা আর্ট গ্যালারি। সবশেষে ধীরধাম মন্দির। ঘ) স্পেশাল পয়েন্টস এবার গঙ্গামায়া পার্ক। দার্জিলিং শহর থেকে ৩৫০০ ফুট নিচে। ঝরণা-ঝুলন্ত ব্রিজ-রং করা বিশাল সব পাথর....আরো কত্তো কী আছে ভেতরে ! টাকার বিনিময়ে নেপালি পোশাক পাওয়া যায়- ছবি তোলার জন্য। সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ পার্ক। পার্ক থেকে বেরিয়ে আসুন। ফেরার পথে রক গার্ডেন। এখানে ৪০০ ফুট উপরে রয়েছে চমৎকার ব্রিজ আর ঝরণা। এটা খো থাকে সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত। যাই হোক,প্রথমে ফুয়েল নিলাম তারপর ছুটলাম রক গার্ডেন এর উদ্দেশ্যে। আমরা এখানে ছিলাম প্রায় ৬০০০ ফিট উচ্চতায়। এবার ডাউন স্ট্রিম এ নামতে লাগলাম আকা বাকা পাহাড়ি পথ ধরে। এক পাশে চা বাগান আর অন্য পাশে পাহারের খাদ এর পর আবার অন্য পাহাড় - যার গায়ে আছে অনেক বাড়ি - দেখতে দারুন লাগে। ভোর পৌনে ৩ টায় মেনেজার এসে আমাদের তুলে দিলো। হোটেলের সামনে থেকে শেয়ারড জিপ গাডি এসে আমাদের তুলে নিলো। প্রথমে যাবো "টাইগার হিল"। যাওয়ার পথ টা দারুন। আমরা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছিলাম। একসময় মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে থাক্তলাম। এক সময় পৌঁছে গেলাম। অনেক উচুতে রেলিং দেয়া একটা জায়গা। সবাই অপেক্ষা করছে সূর্য ওঠার আর কাঞ্চন জংঘা দেখার। ৪/৫ টা মেয়ে কফি যার নিয়ে "কফি কফি" বলে ঘুরছিল। কফি নিয়ে আয়েশে চুমুক দিলাম। ঠান্ডায় কাপছিলাম জেকেট পরেও। সবাই ছবি তুলছিলো।
টাইগার হিল এখানে মেঘের অভাব নেই। সারি সারি মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে। মনে হয় হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। মেঘের ভেলার জন্য কাঞ্চন জংঘা দেখা যাচ্ছিলো না। এটা নাকি লাকের ব্যাপার। এখন আসলে বৃষ্টির সময় বলে মেঘ বেশি। তাই দেখা যায় না। তবে আমরা থাকা কালিন সময় তেমন বৃষ্টি হয়নি ভাগ্য ক্রমে। এখান থেকে ফিরে একটা মনেস্ট্রি আছে। সেখানে গেলাম।
নেক্টস এ গেলাম "বাতাসিয়া লুপ" - খুব ই সুন্দর একটা
বাতাসিয়া লুপ ভালো লাগবে। এখানে বিশাল সাইজের দুরবিন দিয়ে দেখতে পারেন দুরের দৃশ্য। ৩০ টাকা দিয়ে। নেপালি ড্রেস পরে ছবি তুলতে পারেন। ৫০ টাকা লাগবে। এখানে আধা ঘন্টা থেকে আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে। চেক আউট করলাম। প্রথমে খেলাম বিখ্যাত দার্জিলিং এর চা। দারুন। তারপর শিলিগুড়িতে ফিরে অনেক কেনাকাটা করলাম । তারপর আমার বন্ধুর পিসির বাড়ি ধুপিকুড়িতে গেলাম। সেখানে একরাত থাকার পর বাংলাদেশ চলে আসলাম।