বিজ্ঞাপন দিন

জলঢাকায় পিতৃমাতৃহীন মেয়ে শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছে “চাঁদমনি”

আবেদ আলী বিশেষ প্রতিনিধিঃ সমাজসেবা কিংবা জনকল্যাণ যে দৃষ্টিতেই তাকান না কেন সত্যিকার অর্থে দরিদ্র অসহায় জনগোষ্টির বাস্তবতার নিরিখে দিন দিন অনাথ কন্যা শিশুদের আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘চাঁদমনি’। ‘মানুষ মানুষের জন্য’- এই সাইনবোর্ডটি দেখা যায় নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার চাওড়াডাঙ্গী নামক গ্রামের এক বাড়িতে। এই বাড়িটিই ‘চাঁদমনি’। একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলাল।তিনি ‘চাঁদমনির’ প্রতিষ্ঠাতা। ঊনিশ শতাব্দির শেষার্দ্ধে ১৯৯৯ সালে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও কন্যা শিশুদের কথা চিন্তা করে নিঃসন্তান দম্পত্তি আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলাল ও প্রয়াত স্ত্রী মোতাহারা বেগম চাঁদমনি নামে একটি অনাথ আশ্রম শুরু করেন । নীতি-আদর্শের কারণে ব্যাপক প্রচার হয়েছে ‘চাঁদমনি’ জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানটির। সমাজে পিছিয়ে পরা কন্যা শিশুদের নিয়ে কাজ করে ‘চাঁদমনি’। 

এটি মূলত: একটি অনাথ ও দুস্থ বালিকা কল্যাণকেন্দ্র। এপর্যন্ত প্রায় পাঁচশত আবাসিক ও শতাধিক হিন্দু-হরিজন পল্লীর অনাথ ও দুস্থ কন্যা শিশুদের আশ্রয় দিয়ে তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব মেয়ে শিশুদের জন্য পিজিরুলের নিজ বাড়িতেই আছে বিনামূল্যে আবাসিক থাকা,খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা। বর্তমানে এখানে আছে ৫০ জন অনাথ/দুস্থ শিশু-কিশোরী। তারা এখানে থেকে পিতৃ¯েœহে স্কুল -কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে কলেজের ছাত্রী পর্যন্ত মেয়েদের নেওয়া হয়।এলাকাসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন ইউনিয়ন ও উপজেলার বিধবা মায়েরা বিশ্বাসের উপর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে রেখে যায় তাদের আদরের কন্যাকে। আবার সময় হলে নিয়ে যায়। এখানে থাকার শর্ত আছে,বাল্যবিবাহ দেওয়া চলবে না, কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াতে হবে, নিজ ধর্ম ঠিকমতো পালন করবে আর ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। 

লেখা-পড়ার জন্য বাড়ীর ভিতরে নিরিবিলি পরিবেশ ,হলরুম, লাইব্রেরি রুম ও টিভিরুম আছে।তাদের নিজ নিজ ঘরে টেবিল, চেয়ার আছে। আলো আছে।ক্লাশের ছাড়াও বাইরের বই পড়ার সুযোগ আছে। ২০ বছর ধরে একই নিয়মে চলছে ‘চাঁদমনি’। ওরা পাঁচজন ঃ ওদের ৫ জন দিয়ে যাত্রা করে চাঁদমনি। প্রথম ওদের দিয়েই বড় একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণ না হলেও ব্যর্থ হয়নি। ওরা-জেসমিন বানু নিপা,অন্জুয়ারা নিশা,প্রীতি,স্মৃতি ও নীলা। তবে তারা ভোলেনি তাদের ধর্মপিতাকে, ভোলেনি তাদের জীবনসিড়ি চাঁদমনিকে। ওরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। ওদের পরে ঃ ওদের পরে আসে রুবি, দীপা, হেলালিসহ আরও অনেকে।ঘুর্ণায়মান চাকার মতো ওরা নিজেকে গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসে চাঁদমনিতে।তারপর নিজেকে গড়তেই তারা ব্যস্ত হয়।মাঝখানে শুধু একটু সহযোগীতা ,যা তারা পায় চাঁদমনি থেকে। ওরা বর্তমানে সেখানে পঞ্চাশ জন মেয়ে আবাসিক ভাবে আছে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনকে সাজাতে সক্ষম হয়েছে জেসমিন নিপা।সে বিএসসি পাশ করে।বর্তমানে চাকুরী করছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। মনতেজা বানু ও মফেজা বানু সরকারি নার্স। রিতিনা বানু রিতা অর্থনীতিতে এম.এ কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ । সে গৃহিনী। লিপছি আক্তার রুবি এবার বিএসএস পাশ করে অর্থনীতিতে এম.এ কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ছে।এবার বিএসএস পাশ করলো আফরিন নাহার শোভা। 

সে গৃহিনী।পড়ছে অর্থনীতি এম.এ কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছে কলেজ। বিবাহিতরা কেউ এখানে থাকেনা। এখান থেকে এসএসসি পাশ করেছে প্রায় ৮০ জন। চাঁদমনিতে দ্বি-বার্ষিক একটি হস্তশিল্প প্রদর্শনী মেলা হয়। স্থানীয়সহ দূর-দুরান্ত থেকে প্রচুর দর্শণার্থীর সমাগম হয় সেখানে।মেলায় নারী দর্শণার্থীদের প্রচুর উপস্থিতি মেলে। শুরু থেকেই বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে ‘চাঁদমনি’ । কাজ করে সমাজের কু-প্রথা, যৌতুককে নিয়ে। এসব কাজের মধ্যে সামাজিক ও ব্যক্তি সচেতনতা সৃষ্টি করাই প্রতিষ্ঠানটির মূলকাজ। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সর্বদা তৎপর চাঁদমনি। একারণে উপজেলাটিতে বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা অনেকটাই কমে গেছে। সর্বশ্রদ্ধেয় জনাব আবু সাইয়েদ আব্দুলাহর। যিনি এ দেশে ভ্রাম্যমান পাঠাগারের পথিকৃত, তার অনুপ্রেরণায় চাঁদমনির আছে ভ্রাম্যমান পাঠাগার। ভ্যানগাড়ীর উপর সাজানো হয়েছে ভ্রাম্যমান পাঠাগার। এখানে ওখানে ভ্যানগাড়িতে বই দাড় করিয়ে পাঠ করে পড়তে বলা হয়। উৎসাহ পাওয়া যায় অনেকের। আছে পবিত্র কোরান শিক্ষার মাদ্রাসা। বাড়িতেই সপ্তাহে ৪ দিন অভিজ্ঞ আলেম দ্বারা পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। ছবি আকার ক্লাস হয় বাড়িতেই হয় সপ্তাহে ১ দিন। এছাড়া অনাবাসিক কিছু ছাত্রীকে ছবি আঁকা শেখার সুযোগ দেওয়া হয়। বাড়িতেই মাঝে মাঝে (মাসে ১ বা ২ দিন) গানের আসর বসে যেখানে উপযুক্তরা গান শিখতে পারে। এছাড়া কিছু মেয়ে উপজেলার গানের প্রতিষ্ঠানেগলোতে গিয়ে গান শেখার সুযোগ পায়। 

এখানে অবস্থানরত কন্যাদের অভিভাবকগণ বেশি পড়ার সুযোগ না দিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গোপণে বাল্যবিবাহ দিয়ে দেয়। অনেক মেয়ে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবক উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আর পড়তে দেয়না। অনেক পরিবারের ধর্মীয় গোড়ামির কারণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছবি আকা ইত্যাদি শিক্ষায় অনেক মেয়ের আপত্তি থাকে। তাদের বাল্যবিবাহ যৌতুকরোধের কার্যক্রম পুরো সাফল্যের মুখ দেখে না । সমাজকে আলোকিত করতে অবিরত ছুটছেন পিজিরুল আলম দুলাল। তিনি পবিত্র হজ্জ্ব পালন করেছেন ১৯৯৫ সালে। তিনি ছিলেন উত্তরা ব্যাংকের উচ্চতর কর্মকর্তা। স্বেচ্ছায় অবসর নেন ১৯৯৬ সনে। তিনি নি:সন্তান। তার বাবা মরহুম মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মা মরহুমা পিয়ারা আহমেদ ছিলেন একজন গৃহিনী এবং সমাজসেবা কর্র্মী।ঢাকার গোপীবাগের এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। তারা সবাই ছিলেন পিজিরুল আলমের সমাজসেবা কর্মের উৎসাহ দাতা। পিজিরুল আলম দুলাল তার পেনশনের সব টাকা এই কাজেই ব্যয় করেছেন। তাঁর পৈত্রিক এবং নিজের যেটুকু সম্পত্তি ছিল তার প্রায় সবটাই তিনি চাঁদমনি কাজে দিয়ে দিয়েছেন। 

বর্তমানে বার্ষিক প্রায় আট লাখ টাকা ব্যয় খরচ লাগে। তাঁর বন্ধু-বান্ধব, ব্যাংকের পূর্বের সহকর্মী, আত্মীয় স্বজন বিদেশে অবস্থানরত নিকটাতœীয় কেউ কেউ তাকে প্রতিবছর কিছু সহযোগীতা করেন। তিনি নিজে যা পারেন এখনও চাঁদমনিতে খরচ করেন। তাঁর বোন মাসুদ বেগম, ভগ্নিপতি আব্দুল কাদের তাঁকে বাৎসরিক ভাবে সহযোগীতা করে থাকেন করেন। এভাবেই চলছে চাঁদমনি প্রতিষ্ঠান। তবে এর বৃদ্ধিকরণ জরুরী। আরও বেশি গরীব মেয়েদের সাহায্যের আওতায় আনা দরকার। এজন্য দরকার আরও কিছু মহান হৃদয়ের মানুষ,যারা চাঁদমনির সাহায্যে যাঁরা এগিয়ে আসবেন। আবাসিক বাদেও অনেক অনাবাসিক দরিদ্র মেয়েকে পড়াশুনার সাহায্য দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। কিছু বাধা, কিছু অনীহা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদমনি। ৫ থেকে এখন ৫০ জন মেয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে-ক্লাসে। বাড়ছে চাঁদমনির আবাসিক চাহিদা। বাড়ছে আতœকর্মসংস্থানের জন্য উন্নয়ন ভাবনা। এখানে আশ্রিত মেয়েরা দিন দিন উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে। স্থানীয় পরিসরে এতোটুকু হলে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাচ্ছে চাঁদমনি। 

চাঁদমনি প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব পিজিরুল আলম দুলাল বলেন,সমাজের অবহেলিত কন্যা শিশুদের মণিকোঠায় শিক্ষার আলো দেওয়াই চাঁদমনি মূল লক্ষ্য।অভাব-অনটন থেকে বের হয়ে কোন মেয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে তার মাধ্যমে সমাজের মঙ্গল হবেই।আমি আশাবাদী।সে আশা এবং লক্ষ্য নিয়ে চাঁদমনি গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা চাঁদমনির অনাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পিজিরুল আলম দুলালের ভুয়েসী প্রসংশা করে বলেন, সমাজে এমন লোকের সংখ্যা খুবই লগন্ন। নিজের অর্থায়নে নারী শিক্ষায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জলঢাকার চাঁদমনি। তিনি আরো বলেন সমাজের বিত্তশালিদের এরকম প্রতিষ্ঠানে সহযোগীতা করলে প্রতিষ্ঠানটি আরো এগিয়ে যাবে।