বিজ্ঞাপন দিন

জলঢাকায় ফ্রি শিক্ষাঙ্গনে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা জীবনতরী পাঠশালা

মানিক লাল দত্ত,জলঢাকা(নীলফামারী) আলোকিত সমাজ গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে, সমাজের পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার মাধ্যমে মূলস্রোতে ফেরাতে নীলফামারীতে "জীবনতরী"র মাধ্যমে শিক্ষায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন ‘জীবনতরী পাঠশালা' নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সমাজিক সংগঠন। নীলফামারী জেলা শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে জলঢাকা সদরের দুন্দিবাড়ি (মাইজালীপাড়া) গ্রামে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালে । আলোকিত সমাজ গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পরা রোধ করতে, বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করন, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিদ্যালয় মুখীকরন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চত করনে বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে সচেতন করে আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য "জীবনতরী পাঠশালা"র মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে এক ঝাঁক স্বপ্নবাজ তরুণ সদস্যরা। যাদের চোখে আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন। প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মিলে ১৭/১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৬ জন। এরা সবাই আশপাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ১ম ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও তাদের সেবাসমুহ পাচ্ছে। এখানে যেসব শিক্ষক সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিনামূল্যে পাঠদান করাচ্ছেন তারা উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের ৭ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদানে কুইজ প্রতিযোগিতা, সুন্দর হাতের লেখা,কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বই কিনে দিয়ে সহযোগিতা করেন, সমাজের অসহায় ও দুঃস্থ পরিবারের মাঝে ঈদ সামগ্রী দেওয়া, বিভিন্ন ফলের চারা গাছ শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। পাঠ্যদানে নিয়োজিত আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজ, জলঢাকা এর দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত "জীবনতরী পাঠশালা"র শিক্ষক মোঃ সবুজ ইসলাম বলেন আমাদের এখানে যেসব শিক্ষার্থী পড়তে আসে তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়ে। টাকা দিয়ে ভালো প্রাইভেট পড়াতে পারে না। এজন্য আমাদের এখানে বিনামূল পড়তে আসে। আমরা তাদের বিদ্যালয়ের পড়াগুলো প্রস্তুত করে দেই। এতে তারা অনেক উপকৃত হয়। নীলফামারী সরকারি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন ইসলাম (স্বপন) বলেন,এখানে যেসব শিক্ষার্থী পড়তে আসে সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কারো নেই বাবা কারো নেই মা। অনেকের অভিভাবক অশিক্ষিত। ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারে না। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। আমার তাদেরকে বিনামূল্যে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছি, তারা যেন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে না পরে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাদের খাতা, কলম পুরস্কার দেই। পুরস্কার পেয়ে তাড়া আনন্দের সাথে লেখাপড়া করে যাচ্ছে। জীবনতরী পাঠশালায় শিক্ষা নিতে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আলিফ জানায়, আমার বাবা গরীব। টাকার অভাবে প্রাইভেট দিতে পারে না। তাই জীবনতরী পাঠশালায় পড়তে আসি। বিদ্যালয়ের পড়া গুলো প্রস্তুত করে নেই, পড়া শেষ করে বাড়িতে ফিরে যাই। এখানে এসে পড়ালেখার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়েছে। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী আজিমা আক্তার বলেন আগে আমি ভালো করে লিখতে ও পড়তে পাড়তাম না। এখানে স্যার আমাদের লিখা ও পড়া ভালো করে শিখিয়ে দেয়। এখন আমি অনেক ভালো পড়তে পারি। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রহমত আলী মা বলেন,আমি গরীব টাকা দিয়ে ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতে পারি না। আমার ছেলে ভালো ভাবে পড়তে পারতো না, আমি নিজেও পড়াতে পারতাম না। অপিজার রহমান এর সাথে যোগাযোগ করে এই 'জীবনতরী পাঠশালা'য় পড়তে পাঠাই। এখানে এসে অনেক ভালো পড়তে পারে,লিখতে পাড়ে। এখন লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী হয়েছে। আলিফ, আজিমা, রহমত আলীর মতো এরকম হাজারো দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েরা নিজে নিজে পড়তে না পারায় ঝড়ে পড়ে শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে। জীবনতরী পাঠশালার শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখেন লেখাপড়া করে তারা সবাই ভালো মানুষ হবে আলোকিত সমাজ গড়বে। সংগঠনটির প্রধান উদ্দ্যোগতা প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মোঃ অপিজার রহমান গংগাচরা সরকারি কলেজ থেকে (বাংলা) বিষয়ে বিএ অনার্স শেষ করেছে। স্নাতক চতুর্থ বর্ষে অধ্যায়নকালে সামাজিক দায়বোধ থেকে আলোকিত সমাজ গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য কিছু কাজ করার আইডিয়া করে। সেই আইডিয়া এলাকার তরুণদের কাছে শেয়ার করলে তার সাথে একে একে আরো ২০ জন তরুন কাজ করতে উৎসাহিত হয় মোট ২১ জন হয়। ২০১৮ সালে 'জীবনতরী পাঠশালা' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সমাজিক সংগঠন গঠন করে। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অপিজার রহমান বলেন, ‘আমরা ছয় ভাই-এক বোন। অর্থাভাবে সবাই পড়াশোনা করতে পারেনি। ২০১৪ সালে যখন আমি এইচএসসি পাস করি তখনেই এ রকম একটি সংগঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সে সময়ে কারো সাড়া না পেয়ে পরে অন্য বেশ কিছু সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করি। ২০১৮ সালে এলাকার তরুণদের কাছে আইডিয়া শেয়ার করে তাদের নিয়ে 'জীবনতরী পাঠশালা' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সমাজিক সংগঠন গঠন করি। এলাকার অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়ানো ও শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছি। যাতে করে অর্থের অভাবে কারো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায়। আমরা সেই চেষ্টাই করতেছি সামাজিক দায়বোধ থেকে। সংগঠনটির নিজস্ব জায়গা ও ঘর না থাকায় সংগঠনটি চালাতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের নিজস্ব জায়গা ও ঘর হবে। এজন্য আমরা আপনাদের কাছে সর্বাত্বক সহযোগিতা কামনা করছি। নীলফামারী জেলা পরিষদ,জলঢাকা উপজেলা প্রশাসন ও জাতীয় সংসদ সদস্য এবং গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ সংগঠনটিকে উৎসাহ প্রদানে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলে উপজেলার একটি ব্যতিক্রমি মডেল স্বেচ্ছাসেবী সমাজিক সংগঠন হিসেবে আলোর মুখ দেখাতে সক্ষম হবে। সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আতাউল গনি ওসমানী বলেন যে 'জীবনতরী পাঠশালা' সংগঠনের মাধ্যমে কয়েক জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য যে পাঠদান করে যাচ্ছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। জীবনতরীর মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশে শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে আলোকিত সমাজ গড়ে উঠবে। এটি একটি অনুকরণীয় কেন্দ্র হতে পারে। এজন্য সবার সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে আমি করি। জীবনতরী পাঠশালার সদস্যরা সমাজের পিছিয়ে পড়া সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের ভবিষ্যৎ বিনির্মানে কার্যকরী ভুমিকা পালন করছে। তারা বিশ্বাস করে এক মাত্র শিক্ষাই পারে সবাই কে আলোর পথ দেখাতে। শিক্ষা জীবনের শুরুতে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা এইসব শিশুদের মনে যুগিয়েছে সাহস। এই সাহসেই তারা এগিয়ে যাক নতুন উদ্দ্যমে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে ভালো মানুষ হতে পারলেই জীবনতরীর কার্যক্রম গুলো সার্থক হবে।