বিজ্ঞাপন দিন

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায়


 

 প্রাক-প্রাথমিক হলো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বতর্মানে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। আমাদের তৃণমুল পর্যায়ের কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয় ভীতি কাটিয়ে ছন্দে-ছন্দে, নাচে-গানে বর্ণমালার পরিচয় ঘটিয়ে জ্ঞানার্জনের পথে অগ্রসর হতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। এ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের পারিবারিক পরিবেশের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ভিত্তি রচিত হয় এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়। পূর্বে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিদ্যালয় যাওয়ার যে ভীতি ও জড়তা ছিল, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এখন তা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। যার সার্বিক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে ঝড়েপড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে।

 

               প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অভাবনীয় সাফল্যের পরেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। প্রাক-প্রাথমিকের সীমাবদ্ধতা কিংবা সমস্যা এবং তা সমাধানে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কতিপয় বিষয় তুলে ধরা হলো-

(১) শিখনফল উপযোগী আনন্দঘন পাঠদানের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সময়পযোগী শিক্ষা উপকরণের ভুমিকা অপরিহার্য। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুরা বয়সে ছোট হওয়ায় তারা অতি সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ হয়। তাই খেলার ছলে উপকরণের মাধ্যমে পাঠদান বেশি কার্যকর। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা উপকরণের যথেষ্ঠ অভাব থাকায় আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারি না। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে এ সমস্যা বেশি পরিলক্ষিত হয়।

(২) প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে ১:৩০ হওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে এ অনুপাত ১:৬০ কিংবা ১:৭০ ছাড়িয়ে গেছে। এতে করে শ্রেণি শিক্ষক যেমন পাঠদানে হিমশিম খাচ্ছে, পাশাপাশি বছর শেষে শিক্ষার্থীরাও তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না।

(৩) প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ৫+ বছর বয়সী শিশুরা ভর্তি হয়। শিক্ষার্থীদের বয়স কম থাকায় অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না। পাশাপাশি আমাদের মাঠ পর্যায়ের অভিভাবকদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা প্রায় সময়ই শিশুদের নিয়ে আত্মীয় বাড়িতে গমন, শারিরীক অসুস্থতা কিংবা সামান্য কারণেই বিদ্যালয়ে না পাঠানো তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই নিয়মিত অনুপস্থিতি কোমলমতি শিশুদের শিখনের ধারাবাহিক অগ্রগতির ব্যাঘাত ঘটায়।

(৪) শিশুদের শ্রেণি কক্ষে আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি কক্ষ নির্বাচনে বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো কক্ষটিকে অগ্রাধীকার দেওয়ার পরিপত্র থাকলেও আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত কিংবা ব্যাবস্থাপনাগত সমস্যায় তার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। এতে করে বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ কমে যায় এবং আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে প্রতিনিয়ত ব্যার্থ হচ্ছি।

(৫) প্রাথমিক স্তরে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক নামে দু’টি স্বতন্ত্র কারিকুলাম থাকায়, প্রাক-প্রাথমিকের জন্য আলাদাভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেনিতে পাঠদানের জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবশ্যই মনোবৈজ্ঞানিক ভাবধারায় শিশু সূলভ ও বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে এ ধ্যান-ধারণার ঘাটতি থাকায় কিংবা নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত না করার কারণে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।

(৬) আমাদের দেশে এখন পযর্ন্ত শুধুমাত্র পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলোতে পদ সৃষ্টি করা হয়নি। তবে প্রতিটি বিদ্যালয়ের একজন করে শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিকের ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহন করলেও মাঠ পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এ শ্রেণিতে নিয়মিত পাঠদান করা সম্ভব হয় না। এতে করে একটি বৃহৎ অংশ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে।

(৭) আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদের অপ্রত্যুলতা রয়েছে। এ কারণে প্রতি বছর প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন তা বরাদ্দ পাওয়া যায় না। অধিকন্তু প্রাপ্ত বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম অন্তরায় ।

(৮) শিশুদের একঘিয়েমিতা দূর করতে সহপাঠক্রমিক কাযাবলি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক পযায়ে সহপাঠক্রমিক কাযাবলিকে বাধ্যতামূলক করা হলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কাযাবলি পরিচালিত হয় না।

(৯) প্রাথমিক পযায়ে প্রাক-প্রাথমিক একটি বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় যারা পাঠদানে মনোনিবেশ করেছেন, তাদের পাঠদান কৌশল প্রক্রিয়াকে গতিশীল ও আকষনীয় করার জন্য নিয়মিতভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু এ ধরনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় পাঠদানে শিক্ষকদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

(১০) আমাদের দেশে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক কম। এতে করে গ্রামের শিশুরা প্রায়ই বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে। সবার জন্য শিক্ষা কিংবা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ের সমতা সাধন করা দরকার।

(১১) প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা থাকায় এ শ্রেণির কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক বিষয়ক ১৫ দিন ব্যাপী যে প্রশিক্ষন রয়েছে ঐ প্রশিক্ষন শেষে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের শিক্ষক হিসেবে রাজস্ব খাতভুক্ত করার বিধান থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন না হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির পাঠদানে নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারেন না।

(১২) আমাদের সমাজের চারদিকে ব্যাঙ্গের ছাতার মত কিন্ডার গার্ডেন স্কুলগুলো গড়ে উঠেছে। সমাজের সচেতন অভিভাবকরাই এসব বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের ভর্তি করার প্রতিযোগীতায় মেতে উঠেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীরা কিন্ডার গার্ডেনে ভর্তি হয়। আর তুলনামূলক কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই থেকে যাচ্ছে।

 

উপরোক্ত সমস্যাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সমাধানের নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহন করা যেতে পারে:

(১) পাঠ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা উপকরণের যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তাত্ত্বিক শিক্ষার এক ঘেয়েমীতা দূর হয়, শিশুরা পাঠে অধিক মনোযোগী হয় ও আনন্দ লাভ করে।

(২) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০ হতে হবে যাতে পাঠদান করতে কোন অসুবিধা না হয়। শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর উপর নজর দিতে পারে।

(৩) নিয়মিত হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক, মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করতে হবে।

(৪) আমাদের অনেক বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য স্বতন্ত্র প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি কক্ষ নির্মাণ করতে হবে।

(৫) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিশুবান্ধব শিক্ষক নির্বাচনে সর্বাধিক গুরত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংশোধন পূর্বক প্রাক-প্রাথমিক উপযোগী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

(৬) পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ন্যায় বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণকৃত সকল বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করতে হবে।

(৭) প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী পৃথক বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে যে প্রতিষ্ঠানে যেমন বরাদ্দ প্রয়োজন তেমন বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।

(৮) খেলার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ফলে শিশুর মনকে আকৃষ্ট করে ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তাই বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে পড়াশোনা আয়ত্ত করার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।

(৯) গতানুগতিক প্রাথমিক শিক্ষার বাহিরে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা একটি স্বতন্ত্র ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। এই স্বতন্ত্র ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষকদের নিয়মিত বিশেষ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে।

(১০) আমাদের দেশে গ্রামের চেয়ে শহরে প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র অনেক বেশি। তাই গ্রামাঞ্চলেও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সমতা সাধন করতে হবে।

(১১) শিশুদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা বান্ধব, ভীতিহীন পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

(১২) নিয়মিত পরিদর্শন অব্যাহত রাখতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের কী ধরণের অসুবিধা হচ্ছে তা জানা যায়।

 লেখকঃ মো: মাহবুব হাসান,উপজেলা নির্বাহী অফিসার ,জলঢাকা, নীলফামারী।

Post a Comment

0 Comments